Sunday, February 6, 2011

ছুটি মানেই ছুট ……….

কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ ঢুকলেই আমার হাত পা কাঁপে। তারপরেও কিভাবে কর্তার ইচ্ছায় কন্যার হাত ধরে কলকাতা থেকে আমেরিকার লস এনজেলেস শহরে পৌঁছে গেলাম সে গল্প অন্য। ওখানে পৌঁছে টের পেলাম কর্তাটি তার বন্ধুর সঙ্গে দল বেঁধে প্রথম উইক এন্ডেই এক জবরদস্ত বেড়ানোর ছক কষেছেন। ওখানে পৌঁছানোর পর প্রথম উইক এন্ডটি ছিল আমেরিকার লম্বা উইকএন্ড গুলির মধ্যে একটি। আর ওখানে সারা বছরে হাতে গুনে পাওয়া এইসব দিনে লোকজন বাক্স গুছিয়ে বেড়িয়ে পরে, যাকে বলে ঝুলি বগলে বেড়িয়ে পরা। সেই ভাবেই পরিকল্পনা ছিল সান-ফ্রানসিস্কো, ইয়েসোমিতি, আর লেক তাহোই ঘুরে নেবার। বেড়োবার সময় খবর পাওয়া গেল তাহোই-য়ের রাস্তা তখনো বন্ধ তাই সামান্য পরিবর্তন করে সেভেনটিন মাইলস ড্রাইভকে প্ল্যানে আনা হল । খুশী হয়ে সে কথা জানাতেই সুপর্ণা ও শুচিস্মিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাদের বক্তব্য যা দেখেছ লিখে ফেল। ওদের তাড়ায় কলম বাগিয়ে বসে তো পড়লাম কিন্তু মুশকিল হল কলম ভেঙে ফেললেও আমার লেখা এদের লেখার কাছে পৌঁছাবেনা। সে কথা বলতেই ওরা রে-রে করে বলল – ‘লেখ তো।‘ । লেখার নামকরণও তাই শুচিস্মিতার। পাঠকদের কাছে অনুরোধ নিজ গুণে বাকি লেখা ক্ষমা করে দেবেন। আরও একটা কথা লেখার শুরুতে বলেনি – কোন তথ্য সংক্রান্ত ভুল ত্রুটি নজরে এলে অবশ্যই তা শুধরে দেবেন।

মে মাসের ২৮ শে আমরা একটা ৮ সিটার ফোর্ড গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের তিনজনের সঙ্গী হল জ্যোতি, জুলি আর ছোট্ট পায়েল। আমেরিকার ফ্রী ওয়ে ধরে গাড়ী ছুটল সান-ফ্রানসিস্কোর দিকে। শুক্রবারটি ছুটির দিন ছিলনা, তাই বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে। প্রথমদিনেই তাই টানা ৬ ঘন্টা গাড়ী না চালিয়ে প্ল্যানমাফিক আমরা পৌঁছলাম সান- হোসে। এখানেই আমাদের প্রথম রাতের হোটেল বুক করা ছিল। আমেরিকায় বাইরের খাবার বাধ্য না হলে খায়না দলের প্রায় সকলেই, তাই হোটেলের রুমে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল মাইক্রওভেন আর ফ্রীজের। সঙ্গের ঝুলিতে বাঁধা রান্না রাতে খেয়ে ফ্রীজে তুলে রাখা হল, পরেরদিন তা ভরা হবে আইস প্যাকে। অনেকদিন ওখানে থাকায় জুলি এসব ব্যবস্থ্যা করছিল পাকাভাবে, আমার কাজ ছিল ওকে সাহায্য করা।

রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে, ভোরবেলাই আমাদের গাড়ী চলল সান ফ্রান্সিস্কোর দিকে। শহরে যেতে পথে পরবে "মিস্ট্রী স্পট " ( Mystery Spot) । "মিস্ট্রী স্পট " যাবার রাস্তাটি অতীব মনরম । পাহাড়ী পথ বেয়ে লম্বা সব গাছের ছায়া ঘেরা রাস্তা। এই রাস্তারই প্রেমে পড়ে গেলাম আমরা । এখানে তাই সামান্য রাস্তার গন্ডগোল বিরক্তি আনল না কারোরই মনে। এটির অবস্থান সান্তা ক্রুজ়ের রেড উড ফরেস্টের ভিতরে। এই জ়ায়গায় যাবার আগে নাম মাহাত্য ইনটারনেটে ঘেঁটে দেখার সময় আমার হয়নি , কারণ তখনও আমার খুব জেট ল্যাগ চলছিল, সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পরছিলাম আমি। যাইহোক ওখানে পৌঁছে যা বুঝলাম তা হল , এতদিন ধরে বিজ্ঞানের যা নিয়ম কানুন পড়ে এসেছি তার অনেক নিয়ম এখানে উলটে যাচ্ছে। একজনের তুলনায় আরেকজনের দৈর্ঘ্য এপাশ ওপাশ করলেই কমে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে । অথচ আমরা একই সমতলে। মাধ্যাকর্ষন শক্তির বিপরীত কোন শক্তি একজায়গায় যেন আমাদের ঠেলছে। সব মিলিয়ে আধাঘন্টারও বেশী সময় ধরে বেশ মজা পেলাম আমরা। খুদে দুইজনও বেশ ফুর্তিতে ছিল। এই স্পটে টিকিট কাটার পর থেকেই গাইড আমাদের সঙ্গে। গাইডটি বেশ অল্পবয়েসী ও মজাদার। আমার কন্যে খুশী হয়ে গাইডের সহযোগী হচ্ছিল, গাইড যখনই বলছিল। মন্দ কাটল না আমাদের সকালের সময়টুকুন।



এরপরের লক্ষ্য সান ফ্রান্সিস্কো। এই শহরে ঢোকার আগে থেকেই রাস্তা বেশ চড়াই উতরাই। শহরের চেহারা আমেরিকার আর পাঁচটা শহরের চেয়ে কিছু আলাদা নয়, একই রকম সাজানো গোছানো । কেবল এখানকার রাস্তা একেবারে ঢেউ খেলানো । এই আমরা উঁচুতে তো এই নিচুতে । এই ব্যাপারটাই বেশ অন্যরকম। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ ফিসারম্যান রাফ। ওখানে পৌঁছে দেখা গেল পাবলিক পার্কিং এরিয়া ভর্তি। ভীড় দেখে মনে হচ্ছিল বিরাট এক মেলা প্রাঙ্গণ। গাড়ী নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কাছেই এক হোটেল এর পেড পার্কিং এরিয়াতে গাড়ী রাখবার ব্যবস্থা করা গেল। গাড়ীতে বসেই ঝাঁপি খুলে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম আমরা, আর তারপর শুরু করলাম শহর ঘোরা। ফিসারম্যান রাফ জায়গাটি খুব জমজমাট । একদিকে সমুদ্র আর রাস্তার অপরপারে জমজমাট বাজার। খাবারের দোকান, সুভ্যেনিয়রের দোকান। আমরা প্রথমে ছুটলাম ক্রুজের খোঁজে। পৌঁছে গেলাম পিয়ের ৩৯ ("Pier 39"). এখান থেকেই ছাড়বে আমাদের ক্রুজ। দেখা যাবে গোল্ডেন গেট ব্রীজ (Golden Gate Bridge) আর আল্কাত্রাজ জেল (Alkatraz prison), টিকিট কেটে এই জেলের ভিতরেও ঢোকা যায়। কিন্তু আমার কন্যের বেশ ভয় লাগলো "প্রিজন" (Prison) শব্দটিতে, আমাদের হাতেও সময় কম। তাই ক্রুজে চেপে দূর থেকে আল্কাত্রাজ দেখার ব্যবস্থাই আমাদের ভালো লাগলো । লাইন লাগিয়ে জায়গা ভালোই পেলাম ক্রুজের ছাদে । সাধারনত এই জায়গাটি একটু কুয়াশাঘেরা থাকে, কিন্তু আমরা ভাগ্যক্রমে বেশ রোদ্দুরে ভরা দিন পেয়েছিলাম। কিন্তু ক্রুজ যতই গোল্ডেন গেটের দিকে এগোয়, ততই এক শীতল হাওয়া আমাদের ঘিরে ধরে, ওই কড়া রোদেও গায় চাপিয়ে নি গরম পোশাক। ক্রুজের সঙ্গী হল এক দলছুট সীগাল, আমাদের উৎসাহ তাকে ঘিরেও কম না। কম ছবি উঠল না তারও । এগিয়ে এলাম আমরা ব্রীজের নীচে । গোল্ডেন গেটের কথা এতদিন বইয়ে পড়েছি । ছবিতে দেখেছি । এতদিনে তাকে চাক্ষুষ দেখলাম।

ওই ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মেখে ক্রুজ়ের মুখ ঘুরল আল্কাত্রাজ় এর দিকে। আল্কাত্রাজ় কে বাইরে থেকে দেখলে এর অবস্থান ছাড়া বাকি আর কিছুই আর পাঁচটা জ়েলের থেকে আলাদা বলে মনে হবেনা। এর বিশেষত্বই হল এর অবস্থান । বাইরের শীতল আবহাওয়া আর সমুদ্রের জ়লের প্রচন্ড ঘূর্ণি এখানকার বৈশিষ্ট্য। আর আছে এর বিখ্যাত লাইট হাউস , যার উল্লেখ না করলেই নয়। এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা কথাই মনে হচ্ছিল না জ়ানি কত মানুষের কত অশ্রুসজ়ল দিন , কত দুর্বিষহ রাতের কথা জানে এই আল্কাত্রাজ় । একটা মনখারাপের অনুভূতি চেপে ধরল সেই ঝলমলে রোদের ভিতরেও। ক্রুজ় থেকে বড় সুন্দর লাগল সান ফ্রান্সিস্কো ডাউন টাউন । এই সফরের শেষে দেখা মিলল সীলমাছেদের , তারা তখন রোদে গা এলিয়ে ঊচ্চসুরে ডাকাডাকি করছে। তাদের দেখে খুশী হয়ে গেল আমাদের দলের খুদে দুজ়ন আর তাদের খুশীর হাওয়া লাগল আমাদের গায়ে।

এরপর নেমে একটু হেঁটে নিলাম আমরা , সুভ্যেনিয়রের দোকানগুলোতে উপচে পড়ছে ভীড়। চোখে পড়ল ট্রাম, তাতে পর্যটকদের সংখ্যাই বেশী । এখানে শহর ঘোরানোর জ়ন্যে বাসেরও ব্যবস্থা আছে । আমরা আবার গাড়ী নিয়ে রওনা দিলাম। এবার পেরিয়ে যাব গোল্ডেন ব্রীজ , দেখে আসব তার অন্যদিকের দৃশ্য । ঝুলে থাকা ব্রীজেদের মধ্যে এর খ্যাতি বেশ। আর এখনও সান ফ্রান্সিস্কোর অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট এটি । ব্রীজের অন্যদিকে গিয়ে গাড়ী রেখে আমরা হেঁটে এলাম ব্রীজের মাঝবরাবর। এখানকার দৃশ্য আবার অন্যরকম, এ ছবি মনে থাকবে অনেকদিন।
তারপর চললাম লম্বার্ট স্ট্রীটের দিকে। এটি হল আমেরিকার সবচেয়ে বাঁকানো রাস্তা। রাস্তাটি একটি বড় সাপের মত শুয়ে আছে আর বেশ খাড়াই । এখানে গাড়ী চালানোটাই একটা মজার রাইডের মত। পটু হাতে গাড়ী নামাল জ্যোতি । উত্তেজনা জাগছিল এই শহরের সাধারণ রাস্তাতেও, একসঙ্গে এত উঁচুনীচু রাস্তা আমরা আগে দেখিনি। মজা করতে করতে খেয়াল পড়ল সুর্য়্য তখন অস্তমিত, হাতের ঘড়ি বলছে রাত প্রায় আটটা। আমাদের আজকের সফরে এবার ইতি টানতে হবে।

আমরা এবার চললাম মডেস্টো শহরের দিকে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য “ইয়েসোমিতি ন্যাসনাল পার্ক” (Yosemite National Park )। লম্বা ছুটিতে সেখানে আমাদের ঠাঁই মেলেনি একটু দেরী করে ফেলায় । তাই তার কাছাকাছি এই ছোটো শহরটিকে বেছে নিয়েছিলাম আমরা । জী পি এস ( GPS - Global Positioning System ) এর দৌলতে এই ঘোরাঘুরিতে জ়ায়গা খুঁজ়ে পেতে অসুবিধা হয়নি কখনও সেরকম । তারই সাহায্যে আমরা মডেস্টোতে আমাদের হোটেল খুঁজে নিলাম। সঙ্গের রাইস কুকারে চাপল ভাত আর আলুসিদ্ধ । মাইক্রোওভেনে গরম হল তরকারি । এরপর ঘিয়ের কৌটো বেরোতেই সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে সবাই খাবারের জ়ায়গায় ।


পরেরদিন ভোরবেলা ব্রেকফাস্টের পর আমরা চললাম “ইয়েসোমিতি ন্যাশনাল পার্ক” (Yosemite National Park ) এর উদ্দেশ্যে । যাবার পথে প্রথমে রুক্ষু সুক্ষু হলুদ টিলারা পথের দু ধারে ভীর করে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল । ক্রমশ এদের জায়গা কেড়ে নিল ঘন সবুজ়ে মোড়া পাহাড়শ্রেণী । আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্য। ওখানে পৌঁছে তো অবাক। ভীড় দেখে মনে হচ্ছিল আমরা কলকাতার দুর্গা পুজ়োয় ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছি। অনেকক্ষণ গাড়ীর পেছনে লাইন লাগিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম । পুরো রাস্তায় আমাদের সঙ্গে চলল এক পাগলা ঝোরা । ওকে দেখে আমার তিস্তা নদীর কথা মনে পড়ছিল। ওই পাগলা ঝোরাতেই কতজন নেমে পড়েছে সাফীং করতে। কেউ ভীড়ে দাঁড়িয়ে হাঁফিয়ে গিয়ে নেমে পরেছে ছবি তুলতে। ভীড়ের চাপে গাড়ী পার্ক করা মুশকিল , তাও তারই ভিতর কোনরকমে গাড়ী রেখে আমরা এগোলাম। গাড়ী থেকে নেমে একটা পায়ে চলা পথকে সঙ্গী করতেই আমাদের যেন চারিদিক দিয়ে এক নিস্তব্ধতা গ্রাস করল। চারিদিকে এত লোকারণ্য তবু এখানে ইচ্ছা করলেই একলা হওয়া যায়, এতই বিশাল এই বনভূমি । এক বন্য সবুজ় পথ আমাদের পৌঁছে দিল এক সবুজ জলাশয়ের কাছে। আমাদের আগেই আরো এক দল লোকজন পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে। তাদেরই মধ্যে কেউ একজন একটি পাথরের উপর বসে সুর তুলেছিল তার সঙ্গের গিটারে। তার সেই সুর সেই বনানীর নিস্তব্ধতার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফিরে আসছিল আমাদেরই কাছে । চুপ করে গেলাম আমরা। কেবল ছোট্টো পায়েল বড়ই খুশী হয়ে গেল সবুজ জল দেখে , আমার মেয়েও ছুটল বুনো ফুলের উদ্দেশ্যে , এই ফুল দু চারটে নিলে মা বকবে না যে । এখানে জলের মধ্যে ছায়া ফেলেছে লম্বা লম্বা সব গাছ , এদের উচ্চতা দেখে মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা । প্রথম দর্শনেই যা বুঝলাম তা হল এই বনভূমি গাড়ীর জন্যে নয় । একে সেইভাবে দেখতে গেলে পায় হেঁটে চলতে হবে, নিদেনপক্ষে বাই-সাইকেল চলতে পারে। অনেকেই তাই গাড়ীর পিছনে বাই-সাইকেল নিয়ে এসেছে। ছুটকেগুলোকেও দেখছি বাবা মা এর সঙ্গে মাথায় হেলমেট পড়ে চলেছে ছায়াপথ ধরে । মন একটু খারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম কাছ থেকে একে দেখা এ যাত্রায় হবেনা।



ফিরে এলাম গাড়ীতে , আরো অনেকের মত ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে চললাম জ্যামের রাস্তা ধরে । এখানে এ দেশে অকারণে হর্ণ বাজায় না সাধারণত কেউ, একেবারেই যে কেউনা তা হয়তো নয়, কিন্তু যারা নিয়ম মানে না তাদের সংখ্যা এত কম যে চোখেই পরে না প্রায়। গাড়ীতে বসে ভাবছিলাম এই পশ্চিমের দেশগুলোর খারাপ যা কিছু তা আমরা কত সহজে অনুসরণ করি কিন্তু এদের যা ভাল গুণ তা নিতে পারিনা কেন। আমরা কি নিজেদের দেশটাকে সেইভাবে ভালই বাসতে পারিনা। আমি নিজেও । জ্যোতি ভীড়ের মধ্যেই সুন্দর করে একটা জায়গায় গাড়ী রাখল। এবার আমরা চলে এলাম এক সুন্দরী ঝরণার কাছে। এর নাম “ব্রাইডালভেল” (Bridalveil Fall) । প্রায় ৬২০ ফিট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এই ঝরণা । এর দাপট মারাত্বক। এর শক্তিকে অগ্রাহ্য করব এমন সাহস কই, সঙ্গের ক্যামেরার পোশাক গাড়ীতে, তাই ঝর্ণার জলে বেশী ভেজাভেজি করা গেল না। ঝর্ণার জলে ভিজে তখন লোকজনের কি ফূর্তি । এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক আমাদের পিছিয়ে পড়তে দেখে বললেন আমরা ঝর্ণার শেষ না দেখে যেন না ফিরি । কিন্তু আমাদের বুড়ো মানুষের মতন স্বভাব তো একদিনে বদলাবার নয়। এরপর আমরা দেখে নিলাম “রিবন ফল” । দেখার ইচ্ছা ছিল “হর্সটেইল ফল” ও কিন্ত সে ইচ্ছা ইচ্ছাই থেকে গিয়েছিল এই যাত্রায় । এই “Horsetail Fall” এর মাহাত্ম্য হচ্ছে অস্তমিত সূর্য্য যখন এর উপর তার আলো ফেলে তখন একে দেখতে লাগে এক আগুনের শিখার মত। এইখানে বলে নি চারিদিকে এই ঝর্ণাদের দেখার সবথেকে সুন্দর সময় হচ্ছে মে-জুন । অন্যসময় ইয়েসোমিতির অন্য রূপ দেখতে পেলেও এই যে চারিদিকে যে দিকে দেখি সে দিকেই জলধারা এ রূপ অন্যসময় দেখা যায়না।

ইয়েসোমিতি তে সেদিন নেমেছিল মানুষের ঢল । ভীড়ের জন্য অনেক জায়গাতেই আমাদের বেশ দেরী হচ্ছিল। এখানে পাওয়া যায় শাটল বাস ও , এই বাস এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে নিয়ে যায় । নামো , ঘোরো , আবার বাস ধরে নাও। নিজের গাড়ী রেখে এই বাস নিতে পারলে মন্দ হতনা, কিন্তু আমাদের পক্ষে বাস ধরা কঠিন হল ভীরের চাপে। কলকাতার বাসের কথা মনে পরছিল তাদের দেখে । হাল ছেড়ে আমরা গাড়ীকে ভরসা করেই চলতে লাগলাম । এগিয়ে গিয়ে দেখে নিলাম “টানেল ভিউ” । এখান থেকে ভ্যালীর দৃশ্য অসাধারণ । এখানে সুন্দর ভিউ পেলাম আমরা “El Capitan” এর , রোদ্দুরের মোড়কে মোড়া সু-উচ্চ এই গ্রানাইট মোনোলিথকে (monolith ) দেখে মুগ্ধ আমরা । সঙ্গে উপরি পাওনা হল ভ্যালীর দৃশ্য। এখান থেকে দেখে নিলাম আরো একবার “হাফ ডোম” কে । এই পাহাড়টিকে দেখা যায় ইয়েসোমিতি – র অনেক জায়গা থেকে , তবে এক সবুজ জলের উপর ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছি তাকে, পাহাড় আর জলের সেই সখ্যতা ভোলার নয় । আরো দেখলাম ..., তিনভাই পাহাড় (“Three Brothers “) , এরা তিনজন যেন একে অপরের অনুকরণ। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেন গল্প জুড়েছে এখানে । জ্যোতির ইচ্ছায় এবার পাড়ি দিলাম আমরা গ্লেসিয়ার পয়েন্টের দিকে । সে রাস্তা পাহাড় ঘিরে উঠে গেছে অনেক দূর । কিন্তু পুরোটা পৌঁছাবার আগেই হাতের ঘড়ি আমাদের ফিরে যেতে নির্দ্দেশ দিল। ফিরতে হবে অনেকটা পথ । দেখা হলনা গ্লেসিয়ার পয়েন্ট থেকে এই সুন্দরী ভ্যালীকে । মনে মনে তাকে বললাম “এই বেশ হল, এই অপূর্ণতাটুকু সঙ্গে নিয়ে ফিরি , তাহলে আবার আসার ইচ্ছা জাগবে সুন্দরী ......“ ।

নেমে আসতে লাগলাম ভ্যালীর কোলের কাছে , সেই পাগলা ঝোরার কাছে , ততক্ষণে পাহাড়ী পথ বেয়ে সেই বিশাল বনানী জুড়ে সন্ধ্যের আবছায়া আলো । হাত , পা একটু ছাড়িয়ে চলতে শুরু করতেই দেখা গেল সামনে রাস্তা জুড়ে কারা যেন শুয়ে আছে । কাছে এগিয়ে গাড়ী দাঁড় করিয়ে বোঝবার চেষ্টা করতেই , আমার মেয়ের চোখে পড়ল তার দিকের গাড়ীর কাঁচে, দূর থেকে এ কে এগিয়ে আসছে, মেয়ের চিৎকারে সবাই সে দিকে তাকাতেই বুঝে গেলাম এতক্ষণ এ বনানীর সর্বত্র যার নাম দেখে এসেছি, যার ভয়ে এখানে ট্র্যাস-বিনের মুখ আটকানো , ইনি সেই স্বয়ং ভল্লুক মশাই, তাকে দেখে খুশী ও ভয়ের মিশ্র অনুভূতি হবার আগেই আমার কর্তা বুঝে গেছে সামনে যারা রাস্তা জুড়ে শুয়ে আছে তারা কোন গাড়ীতে আহত ভল্লুক শাবক, তাদের চোট খুব বেশী না হলেও সেই মূহুর্তে তাদের ওঠার ক্ষমতা নেই । চলে এলাম আমরা সেই জায়গা ছেড়ে দিয়ে। এগোতেই চোখে পরল তিনটি হরিণ , বুঝলাম জ়েগে উঠছে রাতের বনভূমি। আদিম সেই অন্ধকার আর তার বন্যতাকে পিছনে ফেলে চলতে লাগলাম আমরা শহরের দিকে ।



পরেরদিন ভোর হতেই এক মনখারাপ চেপে ধরল , আজ আমাদের ফেরার দিন , তবে আজও একটু ঘুরে নেব আমরা, ওই যে বলেছিলাম “সেভেনটিন মাইলস ড্রাইভ” । দিনের যাত্রা শুরু হবার ঘন্টাখানেকের ভিতরেই দূরে এক মেঘে ঘেরা পাহাড় নজরে এল , ওই পাহাড়ই যে আমাদের গন্তব্যস্থল তখনও তা বুঝিনি । মনের মধ্যে তখন রূপঙ্করের সুর “মেঘ নেমে এল তার জানালার কাছে” । পৌঁছে গেলাম “সেভেন্টিন মাইলসের” দোরগোড়ায় , গাড়ীর টোল টিকিট কাটার সঙ্গে সঙ্গে জুটে গেল পথের ম্যাপ। বোঝা গেল সেভেন্টিন মাইলস জুড়ে পাহাড় আর সমুদ্রকে ঘিরে বাইশ টি পয়েন্ট। নামো , দেখো ,চলতে থাকো । আর আছে ঘন সবুজ গালচে দিয়ে মোড়া গল্ফ কোর্সেরা । চোখের আরাম সেই সবুজ দেখে । শুরুতেই আমরা উঠে এলাম পাহাড়ের উপরে মেঘ আর কুয়াশার মাঝখানে । আর তারপর বেশ কিছু পয়েন্ট দেখতে দেখতে নেমে এলাম পেবল বীচ এ , এখানে প্যাসিফিক বেশ উত্তাল, তার হাওয়ার দাপট , একপাশের কুয়াশা ঘেরা পাহাড় মনকে যেন কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখানেই বসে থাকি সারাদিন সারাবেলা। সমুদ্রের তেজ দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলাম। এই না হলে সমুদ্র, ফুঁসে উঠছে নেমে আসছে, তার ফেনায় ঢেকে দিচ্ছে আমাদের পা। কিন্তু চলতে তো হবেই । চলতে লাগলাম আমরা । বুনো কাঠবেড়ালীদের আবদার ছেড়ে , হরিণদের মায়াভরা নজ়র ছেরে , সীগালদের ডাকাডাকিতে সাড়া না দিয়ে। এবার গন্তব্য গৃহকোন । ফেরার ইচ্ছা কারোরই নেই , কিন্তু ফিরতে তো হবেই । চারদেওয়ালের মধ্যে থাকতে হয় বলেই কি তার বাইরে বেরোনোর এত ইচ্ছা আমাদের। তাই জন্যেই কি “ ছুটি মানেই ছুটোছুটি “ ? নিয়মটা উলটো হলে কি ইচ্ছাটাও উল্টো হতো ?